ইসলামের ইতিহাস নিয়ে আমি গর্ব করতে পারি না। যে ধর্ম আমাকে আমার স্বাধীনতা দেয় না। আমাদের মতো মানুষকে ঘৃণার চোখে দেখে, আমার অধিকার আমাকেই দিতে চায় না। আমার সমকামী হওয়াকে নাজায়েজ বলে, ধর্মের শেকলে বেঁধে আমার মা বাবাকে আমার কাছ থেকে দূরে ঠেলে দেয় সেই ধর্ম মানতে কষ্ট হয়। আমার অস্তিত্ব ইসলাম অস্বীকার করে। বর্বরতা, পুরুস্তান্ত্রিকতা, আর নারীদের ক্রীতদাসী হয়ে যৌনাচারই করাকে যদি ইসলাম মান দিয়ে থাকে তাহলে এই ধর্মের ভিত্তি নিয়ে আমার অনেক প্রশ্ন। প্রত্যেকটা ধর্মই মানুষের বানানো ধর্ম।
সৃষ্টিকর্তা থাকলে উনি এত বিভাজনে নিজেকে বিভাজন করে রেখেছেন?
আমি ইসলামের ইতিহাসের অধ্যায়ের দিকে তাকিয়ে গর্ব করার মত কিছু খুঁজে পেলাম না।আমি ইসলামের ইতিহাস শিক্ষকের কাছে একটা অতি সাধারণ প্রশ্ন করলাম, “মুহম্মদ গজনী যদি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে সঠিক কাজ করে থাকে তবে ১৯৯২ সালে হিন্দুরা বাবরি মসজিদ ধ্বংস করলে আমরা সমালোচনায় ক্ষোভে ফুঁসে উঠি কেন?” আমার তো মনে হচ্ছে মুহম্মদ গজনী অতীতে হিন্দু মন্দির এবং তাদের পুরোহিতের সাথে যেটা করেছে হিন্দুরা আমাদেরকে আজকে সেটার জবাব দিয়েছে। এই সাধারণ প্রশ্নের কারণেই, মাসের পর মাস আমার সহপাঠী বন্ধুরা আমাকে উত্যক্ত করতে শুরু করে এবং নাস্তিক বলে গালাগালি দেয়।
বন্ধুরা এক পর্যায়ে বুঝতে পারে তারা আমাকে উত্যক্ত করছে। কিন্তু আমার নিজের কাছে মনে হয় শুধু এক ধর্মের অনুসারী হওয়ার সুবাদে একজনের জঘন্য অত্যাচারের কাজের ইতিহাস জেনে ইতিহাসের সত্য বিস্মৃত হয়ে বেঁচে থাকা যায়। নাস্তিকের তকমা গায়ে লাগিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মুক্তচিন্তার মানুষ হিসেবে ধর্মাশ্রয়ীদের তোপের মুখে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অনেক সহজ এখানে। শুধু তাই নয়, স্কুলের আমার সব শিক্ষক যারা আমাদের ইসলামের ইতিহাস পড়াতেন তারা সবাই আমাকে পড়াতেন সবাই ঘৃণা করতে থাকেন।
যখন আমি দশম শ্রেণিতে উঠলাম তখন আমাদের ইসলাম শিক্ষার আংশিক বা পুরোটা অধ্যায় জুড়েই থাকত আরবি লেখা কোরআন। আমি আরবির কিছুই জানতাম না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্কুলের প্রতি ক্লাসের প্রধান দরজার উপরে লেখা থাকত “ইংরেজিতে কথা বল” কিন্তু যদি ছাত্র আরবিতে কোরআন পড়তে না পারত তবে তার জন্য শাস্তির অভাব ছিল না।
সুতরাং বাংলাদেশে বাস করে আমি বুঝে গেলাম আমাকে আরবি শিখতে হবে, অনর্গল কোরআন তেলাওয়াত শিখতে হবে, পবিত্র রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষা করে চলতে হবে, আজানের সময় আজানকে সম্মান দেখিয়ে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকতে হবে এবং অবশ্যই নামাজ পড়তে যেতে হবে। ইসলামিক রিপাবলিক দেশে আপনাকে পুরো রমজান মাসে দিনের বেলায় না খেয়ে থাকতে হবে যাতে আশেপাশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না লাগে, আপনার কারণে যেন তাদের রোজা ভঙ্গ না হয় সেটা খেয়াল রাখতে হবে। এটা শুধু বাংলাদেশের দৃশ্য নয় রমজান মাসের এই চিত্র দেখা যায় মুসলিম অধ্যুষিত সব দেশে। রমজান মাসে প্রকাশ্যে পানাহারের অভিযোগে আপনাকে প্রকাশ্যে পেটানো হতে পারে।
আমরা সামাজিক জীব। পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাদের মস্তিষ্কের সর্বাধিক বিকাশ হয়েছে। আমরা চিন্তা করতে পারি, প্রচলিত কোন বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি, প্রশ্ন করতে পারি, গবেষণা করতে পারি, আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করতে পারি। আর এভাবেই মানুষ আজকের উন্নত প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যদি মানুষকে বলা হয়, আপনারা আর চিন্তা করবেন না। যদি এখন থেকে চিন্তা করেন এবং কোন বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করেন, তবে আপনার সন্দেহ আর চিন্তা মৃত্যুর দিকে ধাবিত করবে। যদি আপনার গবেষণা এবং আবিষ্কারের নেশাকে অনৈতিক এবং ক্ষতিকর মনে করা হয় তখন কেমন লাগবে? যদি আপনার উদ্ভাবনকে মনে করা হয় আইনের পরিপন্থী? কেমন হবে যদি দেখেন আপনার চারিপাশের মানুষ প্রগতিকে পছন্দ করছে না বরং প্রতিনিয়ত তাগিদ দিচ্ছে ৭ম শতকে ফিরে যেতে?
মনে করুণ আপনি কারো ভাই, আপনার ছোট একটা বোন আছে। আপনি বাস করছেন চলমান আতংক মিশ্রিত ভয়ের মধ্যে। কেমন মনে হবে আপনার কাছে যদি দেখেন আপনার ছোট বোনটি হাসপাতালে ভর্তি, তার শরীরে সর্বত্র নির্যাতনের ছাপ স্পষ্ট, তার মুখে পাঁচ আঙুলের চড়ের দাগ, তার পোশাক কেউ ছিঁড়ে ফেলেছে হ্যাঁচকা এক টানে, তার চোখ বলছে বেঁচে থাকার জন্য সে কতটা লজ্জিত? এবং যখন আপনি আদালতে গেলেন, আপনার নির্যাতিত বোনকে বলা হলো কয়েকজন সাক্ষী হাজির করতে যারা দেখেছে তাকে শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছে এবং নিশ্চিত করতে হবে যে সে কাপড়ের বস্তার মত বোরখা পরেছিল কিনা? সে যদি চারজন সাক্ষী জোগাড় করতে না পারে তাহলে কোন মামলা দায়ের করা যাবে না। সুতরাং আইনের চোখে কোন ধর্ষণ হয় নি! তখন কি আপনি জনে জনে জিজ্ঞেস করে বেড়াবেন, ভাই, একটু শুনবেন, এই মেয়েটাকে দেখেছেন? সে আমার বোন, আপনি কি দেখেছেন সে ধর্ষিত হয়েছে? প্লিজ ভাই, আমাকে একটু সাহায্য করেন, আমার চারজন সাক্ষী দরকার! অথবা আপনি কি নিশ্চুপ থাকবেন এবং কখনো আপনার বোনকে ভাই হিসেবে আপনার মুখ দেখাতে পারবেন?
যদি আপনি একজন বড় বোন হন এবং দেখেন আপনার ছোট ভাই বাড়িতে ফিরে এসেছে ভাঙা আঙুল নিয়ে, কারণ সে স্কুলে এক-পিস রুটি তুলে খেয়েছিল রমজানের দিনে, অথবা যদি দেখেন আপনি রমজানের দিনে স্কুলে টিফিন দিয়েছিলেন বলে কেউ আপনার ভাইয়ের চোয়াল ভেঙে দিয়েছে কেমন লাগবে আপনার? যদি আপনি এমন একটা সমাজে বাস করেন যেখানে আপনার চারপাশের মানুষের ব্যক্তির প্রতি কোন সম্মান নেই, ব্যক্তি সম্মান নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যথা নেই, কারো কোন স্বাভাবিক বিচার বিবেচনা বোধ নেই তখন আপনি কী করতে পারেন? সেখানে কীভাবে বাস করবেন? একজন দাসের মত অনুভূতি নিয়ে বেঁচে থাকা, আপনি যা নিজে অন্তর থেকে ধারণা করেন না তাই অনবরত সেজে থাকার অভিনয় করা, আপনার নিজেকে প্রকাশ করার উপর বিধিনিষেধের অব্যক্ত যন্ত্রণা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।
আমি আমার মতো করে পোশাক পড়তে পারি না। কানে দুল পরলে আমি হয়ে যাই হিজড়া। কেন হিজড়ারা মানুষ না? ওরা কেন ওদের পরিবারে থাকতে পারে না? হিজড়া হলেই কেন পরিবার থেকে বের করে দেয়া হয়? হিজড়া হয়ে জন্মালে সেই বাচ্চা শিশুটার দোষ কোথায়? আমাদের সমাজটা এই সকল প্রশ্নের উত্তর কখনো দেয় না। এই সকল উত্তর চাইতে গেলে মেরে হাড়গোড় ভেঙ্গে দেয়। কি অসহনীয় যন্ত্রণা হয় বুকের মধ্যে। যন্ত্রণা গুলো জমে জমে ক্ষত হয়ে যায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।