বাংলাদেশ একটি সংবিধানিক গণতান্ত্রিক দেশ। এই রাষ্ট্রে প্রতিটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার রয়েছে—নিজের মতো করে বাঁচা, ভাবা, ভালোবাসা, এবং বিশ্বাস করা। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, দেশের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী এখনো সেই মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত—শুধু যৌন অভিমুখতা আলাদা বলে।

এই প্রেক্ষাপটে বারবার একটাই প্রশ্ন উঠে আসে: একজন মানুষ, কেবল কার প্রতি আকৃষ্ট হন বা ভালোবাসেন, সে কারণে কীভাবে অপরাধী হতে পারেন?

সমকামীতা কোনও বিকৃতি নয়, বরং এটি একটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য। আধুনিক বিজ্ঞান আজ বলছে—মানুষের মস্তিষ্ক, জিনতত্ত্ব, হরমোন ও গর্ভকালীন পরিবেশ যৌন প্রবৃত্তি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এটা এক ধরনের জৈবিক পূর্বনির্ধারণ—যা পরিবর্তনযোগ্য নয়।

তবুও, বাংলাদেশে আজো দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বলবৎ রয়েছে, যা সমকামী যৌন আচরণকে “প্রকৃতিবিরুদ্ধ” বলে আখ্যায়িত করে। এর শাস্তি? যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত। এটি শুধু অমানবিক নয়, বরং বৈজ্ঞানিক, সামাজিক ও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি বেআইনি বৈষম্যের রূপ

বাংলাদেশের ধর্মপ্রধান সমাজে ধর্মশাস্ত্রের কিছু ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমকামিতাকে “পাপ” বলে দেখা হয়। এখানে প্রধানত ইসলাম ধর্মের প্রভাব সুস্পষ্ট। অনেকেই দাবি করেন, “ইসলাম শান্তির ধর্ম”। কিন্তু যখন কোনো ধর্মীয় ব্যাখ্যার কারণে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ছড়ানো হয়, তা আর শান্তি নয়—তা হয়ে দাঁড়ায় নির্যাতনের বৈধতা

এখানে প্রশ্ন শুধু ইসলামের নয়—খ্রিস্টধর্ম, ইহুদি ধর্ম, এমনকি হিন্দু ধর্মের পুরনো ব্যাখ্যাগুলিও বহুসময় ধরেই সমকামীদের প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে। ধর্মের দায় নয় বরং ধর্মের অসচেতন ব্যাখ্যা—এই বিভাজনের মূলে।

তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, প্রতিটি ধর্মের মধ্যেই মানবতা, ভালোবাসা ও সহানুভূতির শিক্ষা রয়েছে। সেই মূল শিক্ষার আলোতেই আমাদের ধর্মীয় ব্যাখ্যাগুলোর পুনঃপাঠ জরুরি।

বাংলাদেশে LGBTQ+ ব্যক্তিরা এক অদৃশ্য সংখ্যালঘু হিসেবে সমাজে বেঁচে থাকেন। অধিকাংশই পরিচয় গোপন করে বাঁচতে বাধ্য হন—পারিবারিক চাপে, ধর্মীয় ভয় দেখিয়ে, আইনের হাত থেকে বাঁচতে। যারা পরিচয় প্রকাশ করেন, তাদের অনেকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া, জোরপূর্বক বিয়ে, শারীরিক নির্যাতন, এমনকি পুলিশের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হন।

২০১৬ সালে দুইজন এলজিবিটি কর্মীকে ঢাকায় প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়। আজও সেই হত্যা তদন্তে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এটি স্পষ্ট করে যে, রাষ্ট্রীয় স্তরেও এই জনগোষ্ঠীর প্রতি কোনো দায়িত্ববোধ কাজ করছে না।

আমার চাওয়াগুলো খুব সামান্যঃ

  1. দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করুন—যা শুধুমাত্র ঘৃণার ভিত্তিতে একটি প্রাকৃতিক আচরণকে অপরাধ বানিয়েছে।

  2. বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়ন করুন, যেখানে যৌন অভিমুখতা স্পষ্টভাবে সুরক্ষিত থাকবে।

  3. ধর্মীয় সংলাপ ও শিক্ষা—ধর্মের মানবিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে হবে, যেন মানুষ ঘৃণা নয়, সহানুভূতির শিক্ষা পায়।

  4. স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সচেতনতা শিক্ষার অংশ করুন—যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জ্ঞানের ভিত্তিতে সমতা শিখে বড় হয়।

  5. LGBTQ+ সম্প্রদায়কে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ও চিকিৎসা, মানসিক স্বাস্থ্যসহ ন্যায্য সুযোগ দিতে হবে।

 


 

উপসংহার

 

কেউ কাকে ভালোবাসে—তা কখনো অপরাধ হতে পারে না। ধর্ম যদি কারো জীবনের অধিকার কেড়ে নেয়, তাহলে সেই ধর্মকে প্রশ্ন করাই মানবতা। বাংলাদেশ যদি সত্যিই একটি মানবিক, আধুনিক ও প্রগতিশীল দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে চায়—তাহলে সমকামীদের অধিকার, সম্মান ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই হবে।

মানবাধিকারের আলোয় ধর্মীয় অন্ধতাকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলুন—একটি সমানাধিকারভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য।