মানুষের মধ্যে অনেক ভ্রান্ত ধারনা আছে যেখানে সমকামিতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা থেকে আজ বিষয়টা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে সমকামিতা / বা সমকামী মানুষ ইচ্ছা প্রণোদিত হয়ে সম্পর্কে আবদ্ধ হয় না। বরং এর পেছনে রয়েছে আমাদের শরীরে অবস্থিত জিনদ্বয়ের এক সমুন্নত অংশগ্রনের যোগফল।

সমকামিতা কি জৈবিক ভাবে পূর্ব নির্ধারিত? সাম্প্রতিক গবেষণা বলছে পুরুষ সমকামীদের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কমন দুইটি জিনের প্রকরণ পাওয়া গিয়েছে; যার উপর ভিত্তি করে বলা যেতে পারে, হ্যাঁ, পূর্ব নির্ধারিত।

কিন্তু আমরা তো জানতামই ”গে জিন” বলে কিছু একটার অস্তিত্ব আছে, তাই না?

আমরা প্রায় এক দশক ধরে জানতাম যৌন অভিমুখিতা পুরুষে আংশিকভাবে বংশানুক্রমে আসে। এর জন্য আমাদের ১৯৯৩ সালের গবেষণাটিকে ধন্যবাদ না দিলেই নয়। যেখানে পরিবারকে ভিত্তি করে দেখানো হয়েছিল, কিছু লোক কিভাবে বিষমকামী, আর কিছু কেন সমকামী হয়। সেখানে দেখানো হয়েছিল যে এক্স ক্রোমোজমের এক্সকিউ২৮ এলাকাটির সাথে মানুষের সমকামী বা বিষমকামী হওয়ার একটা সংযোগ আছে। ২০১২ সালে ৩৮৪ টি পরিবারের ৪০৯ জোড়া যমজ সমকামী ভাইয়ের উপর করা গবেষণা থেকে দেখা যায়, সমকামিতার সাথে এক্সকিউ২৮ এর সংযোগ আছে; যা ৯৩ তে করা হ্যামারের গবেষণাকে সমর্থন করে। একই সাথে এই গবেষনা থেকে দেখা গিয়েছে, ৮ নং ক্রমোজমে অবস্থিত সেন্ট্রোমিয়ারের কাছাকাছি এলাকা 8q12 এর সাথেও সমকামিতার সংযোগ আছে। এই গবেষণা প্রতিবেদন ২০১৪ সালে প্রকাশিত হয়। তবে এই গবেষণা গুলো থেকে সমকামিতার সাথে জড়িত সুনির্দিষ্ট কোনো জিন আবিষ্কৃত হয় নি।

তাহলে সাম্প্রতিক এই গবেষণায় নতুন কি আছে?

প্রথমবারের মত যৌন অভিমুখিতা বালক ও পুরুষে; গর্ভে ও জীবনকালে কিভাবে ক্রমবিকশিত হয় তা ব্যাখ্যা করতে পারে এরকম স্বতন্ত্র জিন আবিষ্কৃত হয়েছে।

তার মানে নির্দিষ্ট জিন আবিষ্কৃত হয়েছ, কিন্তু এই গবেষণা কিভাবে করা হয়েছে?

ইলিনয়ে অবস্থিত; নর্থ শোর বিশ্ববিদ্যালয়ের এলান স্যাণ্ডারস এবং তার সহযোগীরা এই জিনকে বাছাই করেন। তারা এর জন্য ১০৭৭ জন সমকামী ও ১২৩১ জন বিষমকামীর মধ্যে তুলনা করেন। তারা জিনোম ওয়াইড এসোসিয়েশন স্টাডিজ (GWAS) (ডিএনএ স্ক্যানিং এর পদ্ধতি) করেছেন। করেছেন পুরুষের পুরো জিনোমকে স্ক্যান, অন্বেষণ করেছেন, ডিএনএর ক্রমবিন্যাসে অন্তত একটি লেটার ও ভিন্ন কিনা। এই জন্য গবেষকরা, সেসব ব্যক্তির থেকে লালা বা রক্ত সংগ্রহ করেছেন। তারপর তাকে শ্রেণীবিন্যাসিত করেছেন। তারা পেয়েছেন, এই ভিন্ন প্রকরণ বিশিষ্ট দুটি জিন; যার সাথে যৌন অভিমুখিতার সংযোগ থাকতে পারে।

কোন জিনদ্বয় তারা খুঁজে পেয়েছেন এবং সেগুলোর কী কাজ?

গবেষকরা পুরো ক্রোমোজম নিয়ে কাজ করার বদলে, ক্রোমোজমে এমন এলাকা খুঁজার চেষ্টা করেছেন, যেখানে বহুসংখ্যক multiple single nucleotide polymorphisms (ডিএনএ তে একক লেটার পরিবর্তিত) থাকে। এরকম এলাকা তারা পেয়েছেন ১৩ ও ১৪ নং ক্রোমোজমের উপর। ১৩ নং ক্রোমোজমের উপর অবস্থিত দৃঢ় সংযোগ টা পাওয়া গিয়েছে SLITRK6 এবং SLITRK5 জিনের মধ্যে। SLITRK6 হচ্ছে নিউরোডেভেলপমেন্ট জিন। এটা ডিয়েনসেফালন (মধ্যমস্তিষ্ক) নামক মস্তিষ্কের একটা অংশে সক্রিয়। মজার বিষয় হলো এই এলাকাটি হাইপোথ্যালামাসকে ধারণ করে। মজার, কারণঃ ১৯৯১ সালে দেখা গিয়েছিল সমকামী এবং বিষমকামীর মস্তিষ্কের এই অংশের যে আকার বা সাইজ তাতে পার্থক্য আছে। সাইমন লিভ্যে এটি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনি সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার দেখে বলেছেন যে, এই জিন আবিষ্কারের ফলে তিনি অত্যন্ত উত্তেজিত কারণ এটা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, তার আবিষ্কারটাও যথার্থই ছিল।

“অন্য আরেকটি গবেষণা থেকে পাওয়া গিয়েছে, এই SLITRK6 জিনটি, তা পুরুষ ইদুঁর ফিটাসের হাইপোথ্যালামাসে জন্মের কিছুদিন পূর্বে সক্রিয় হয়।” লিভ্যে আরো বলেছেন, “মস্তিষ্কের এই অংশে যৌনতার পার্থক্যকরণেরর জন্য একে বিবেচনা করা হয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় হিসেবে। তিনি আরো বলেন, যৌন অভিমুখিতার ক্ষেত্রে নিউরোএনাটমি এবং আণবিক জীনগত ব্যবস্থায় এই সুনির্দিষ্ট সংযোগটি সম্ভাবনাময়।

অন্য জিনটা কী?

অন্য জিনটা পাওয়া গিয়েছে ১৪ নং ক্রোমোজমে এবং এটি প্রধানত থাইরয়েডে সক্রিয়। একে বলা হয় TSHR (thyroid stimulating hormone receptor)। এটি একধরনের রিসেপ্টর প্রোটিন যা শনাক্ত ও আবদ্ধ করে একটি হরমোনকে যা থাইরয়েডকে উদ্দীপ্ত (stimulates) করে। এইভাবেই এই জিনটি থাইরয়েডের ফাংশন বা কার্যাবলীকে নিয়ন্ত্রণ করে। টিএসএইচআরের বিভিন্ন ধরনের সংযোগ আছে। যেমনঃ এর সাথে জড়িত হিপোপক্যাম্পাস (মস্তিষ্কের অংশ) শর্ট টার্ম মেমোরী (স্বল্প স্থায়ী স্মৃতিকে) দীর্ঘ স্থায়ী স্মৃতিতে পরিণত করে। থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের প্রকৃতির সাথে এই জিন সংযুক্ত। ফ্যাক্ট হলো টিএসএইচআর; যৌন অভিমুখিতা নির্ধারণে জড়িত এমন তথ্যের সাথে এই গবেষণার প্রতিবেদন মিলে যায়। জিনগত অবস্থা-গ্রেইভ ডিজিজের কারণে টিএসএইচআরের কার্যক্রম ব্যাহত হয়; এটি হলো স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যা থাইরয়েড গ্রন্থিকে অতি সক্রিয় করে তুলে। এরফলে বিপাকীয় ক্রিয়ার হার বেড়ে যায় এবং ওজন হ্রাস পায়। গ্রেইভ ডিজিজ বিষমকামী পুরুষদের তুলনায় সমকামী পুরুষে বেশি দেখা যায় এবং কিছু গবেষণা দেখিয়েছে যে, সমকামী পুরুষরা বিষমকামী পুরুষদের তুলনায় অধিক কৃশকায় (শুকনো) হন।  এটা হতে পারে; থাইরয়েডের অতিসক্রিয়তার কারণে। গর্ভবতী মায়ের থাইরয়েডে ত্রুটি দেখা গেলে, সন্তানের পরবর্তী সময়ে সমকামী হবার সম্ভাবনা থাকতে পারে– এরকমটাও একটা গবেষণায় দেখা গিয়েছে। এই সমস্ত প্রাপ্ত তথ্যকে পর্যালোচনা করে এটা প্রায় নিশ্চিয় যে; সমকামিতার সাথে থাইরয়েড গ্রন্থিতে সক্রিয় জিনের একটা সম্পর্ক আছে।

আমরা সবসময় মানুষের শোনা কোথায় কান দিয়ে চলি। এর অর মুখ থেকে যা শুনি সেটাই বিশ্বাস করি। কিন্তু সত্যকয়ে জানার চেষ্টা করি না। সমকামিতা নিয়ে ভ্রান্ত ধারনাগুলো এভাবেই সমাজে নিজেদের স্থান করে নিয়েছে যুগ যুগ ধরে। একজন মানুষ কেন সমকামী  হয় তার এক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছি।