
বাংলাদেশ যার জন্ম হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে। অথচ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসে আমরা দেখছি এক ভয়াবহ বাস্তবতা যেখানে ধর্মীয় উগ্রতা আর মৌলবাদ শুধু বাড়ছে না, বরং রাষ্ট্র ও সমাজের নীতিনির্ধারণেও প্রভাব বিস্তার করছে।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে ইসলামপন্থী রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও জঙ্গিগোষ্ঠীগুলোর উত্থান আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম, জামাত-উল-মুজাহিদিন, হরকাত-উল-জিহাদ কিংবা তথাকথিত আইএস অনুপ্রাণিত গ্রুপগুলো এখন আর শুধুই অদৃশ্য শক্তি নয়, এরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে শিকড় গেড়ে ফেলেছে। রাজনীতির মাঠে জামাত-হেফাজতের মতো সংগঠন এখন আর পরস্পর বিরোধী নেই, বরং তারা এক ব্যানারে কথা বলছে একটি শরিয়া-ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে।
এটি কেবল মুক্তচিন্তকদের জন্য হুমকি নয়, বরং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু, নারী, এবং সবচেয়ে অবহেলিত গোষ্ঠী এলজিবিটি সম্প্রদায়ের জন্য এক চরম উদ্বেগজনক পরিস্থিতি।
এক ভয়াবহ বাস্তবতা: এলজিবিটি জনগোষ্ঠী নিশানা
বাংলাদেশে সমকামীতা এখনো আইনত অপরাধ। ব্রিটিশ আমলের দণ্ডবিধি ৩৭৭ ধারায় “প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার” হিসেবে সমকামী সম্পর্ককে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এই আইনের ছত্রছায়ায় পুলিশ ও প্রশাসন ইচ্ছেমতো হেনস্তা করতে পারে যেকোনো এলজিবিটি ব্যক্তিকে—এবং তাই করছে।
LGBTQ+ জনগোষ্ঠী যারা গোপনে নিজেদের মতাদর্শ নিয়ে কাজ করছেন—যেমন “রূপবান”, “বয়েজ অফ বাংলাদেশ”, “কমলা সুন্দরী”, “রংধনু”—তাদের অনেক সদস্যকে চুপিচুপি আটক, নিখোঁজ কিংবা হয়রানির শিকার হতে হয়েছে। রাষ্ট্রীয় স্তরে তাদের স্বীকৃতি তো দূরের কথা, এখন তাদের অস্তিত্বই অস্বীকার করা হচ্ছে।
অনলাইনেও তাদের নিরাপত্তা নেই। ইসলামপন্থী উগ্র গোষ্ঠীগুলো তাদের বিরুদ্ধে ফতোয়া দিচ্ছে, হুমকির বার্তা ছড়াচ্ছে, এমনকি হত্যার তালিকাও তৈরি করছে। সমকামিতা নিয়ে ঘৃণাত্মক ভিডিও, প্রবন্ধ ও প্রচার ছড়িয়ে দিয়ে সমাজকে এক ভয়ঙ্কর বিভক্তির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।
কেন রুখে দাঁড়ানো জরুরি
বাংলাদেশের জঙ্গিবাদ কেবল ধর্মের নামে বোমা-গোলায় সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি ধারাবাহিক সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, যা মুক্তবুদ্ধি, সমানাধিকার এবং মানবাধিকারের সবকিছু ধ্বংস করে দিতে চায়। শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার যে গোপন পরিকল্পনা চলছে, তার মূল শিকার হবে নারী, সংখ্যালঘু, আর এলজিবিটি মানুষ।
আমরা যদি এখনই না জাগি, তাহলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ হতে পারে এক নতুন আফগানিস্তান—যেখানে কেউ আর নিজেকে প্রকাশ করতে পারবে না, ভিন্নমত প্রকাশ করতে পারবে না, নিজের ভালোবাসার মানুষকে বেছে নেওয়ার অধিকার হারাবে।
সমাধান কী?
-
নীতিগত পরিবর্তন: বাংলাদেশে বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরি। এলজিবিটি মানুষের নিরাপত্তা, অধিকার এবং মর্যাদা নিশ্চিত করার মতো রাষ্ট্রীয় আইন থাকা দরকার।
-
সাহসী সাংবাদিকতা: দেশের ভেতরে ঘটে যাওয়া এসব নিপীড়নের ঘটনাগুলো আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।
-
সচেতনতা ও সহানুভূতির চর্চা: সমাজে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, যৌন বৈচিত্র্য এবং মানবাধিকারের বিষয়ে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
-
নাগরিক আন্দোলন: ধর্মীয় উগ্রতার বিরুদ্ধে, এবং মানুষের মৌলিক অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়া এখন সময়ের দাবি।
বিশ্বজুড়ে, সমকামী ব্যক্তিরা বৈষম্য, সহিংসতা, হয়রানি এবং সামাজিক কলঙ্কের সম্মুখীন হচ্ছে। অনেক দেশে সামাজিক আন্দোলন গ্রহণযোগ্যতার দিকে অগ্রগতি লক্ষ্য করা গেলেও, অন্যান্য দেশে সমকামিতাকে অবৈধ এবং শাস্তিযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে, কখনও কখনও মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
LGBTQ+ ব্যক্তিরা ভিজিল্যান্ট গোষ্ঠী বা জনতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে, যারা তাদের শাস্তি ছাড়াই মারধর বা হত্যা করতে পারে। যখন তারা কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্য চান, তখন তারা আরও নির্যাতনের শিকার হতে পারেন, কারণ পুলিশ এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা তাদের অভিযোগ উপেক্ষা করতে পারেন অথবা এমনকি সমকামিতার অভিযোগে তাদের গ্রেপ্তারও করতে পারেন।
বাংলাদেশে সমকামীদের জীবন দুর্বিষহ। কেবল সামাজিক বিদ্বেষ নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য চলমান। পুলিশি হয়রানি, গোপনে গ্রেফতার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, পরিবারের দ্বারা নির্যাতন, এমনকি খুন পর্যন্ত সবই বাস্তবতা। অনেকে জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা গোপন কমিউনিটি যেন একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই আশ্রয়ও নিরাপদ নয়। উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকি, অনলাইন নজরদারি এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে নজরদারি সব কিছুই সমানতালে বেড়েছে।
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংবিধান অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ, পছন্দ ও জীবনযাপন করার অধিকার থাকা উচিত। অথচ, সমকামীদের এই ন্যায্য অধিকার সংবিধান স্বীকৃতি দিলেও, বাস্তবে আইনি ও সামাজিক কাঠামোতে তা ধ্বংস হয়ে যায়। জাতিসংঘের বিভিন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশ LGBTQ+ অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, আমাদের প্রতিনিধি দল সব সময় বলে—“এটা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতি কি মানুষের অধিকারের চেয়ে বড়?