সমাজে যৌন পরিচয় ও আকাঙ্ক্ষার বৈচিত্র্য নতুন কোনো বিষয় নয়। মানব ইতিহাসের আদিকাল থেকেই এই বৈচিত্র্য বিদ্যমান। তবুও, আজকের সমাজে উভকামিতা (Bisexuality) যেন সবচেয়ে ভুল বোঝা ও প্রশ্নবিদ্ধ পরিচয়গুলোর একটি।

‘ডাউন লো’ কালচার: অস্বীকারের মধ্যে বসবাস

আমাদের সমাজে এমন বহু পুরুষ আছেন যারা নিজের বিবাহিত পরিচয়ের বাইরে অন্য পুরুষের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন। কিন্তু তারা নিজেদের সমকামী বা উভকামী বলে স্বীকার করেন না। তারা নিজেদের “সোজা” বা “নরমাল” দাবি করেন, কারণ সমাজে সমকামিতা বা উভকামিতা এখনো কলঙ্ক বলে বিবেচিত। এই সাংস্কৃতিক দ্বিচারিতা ও সামাজিক ভয় এক ধরনের ‘ডাউন লো’ কালচারতৈরি করেছে।

এই আচরণের পেছনে দায়ী:

  • ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা

  • আইনের ভয় (৩৭৭ ধারা)

  • পরিবার ও সমাজের চাপ

  • নিজের স্বীকৃতি নিয়ে দ্বিধা

ফলে এসব মানুষ নিজের সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন—নিজের সাথেই এক ধরনের যুদ্ধ করতে করতে।

উভকামী অদৃশ্যতা বলতে বোঝানো হয়, যখন উভকামীদের অস্তিত্ব, ইতিহাস এবং যৌন অভিমুখতা সমাজ, গণমাধ্যম বা গবেষণায় যথাযথভাবে তুলে ধরা হয় না। প্রায়শই বলা হয়, “এরা কনফিউজড”, “এরা ঠিক হয়ে যাবে”।

এই ধরণের মন্তব্য ও দৃষ্টিভঙ্গি বাইফোবিয়ারই রূপ, যা উভকামীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। তারা হয় সমাজে, নয়তো এমনকি এলজিবিটি কমিউনিটির মধ্যেও নিজেদের জায়গা খুঁজে পায় না।

বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও বাস্তবতা

  • ডাঃ মার্টিন ডাউনিং জুনিয়রের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি পাঁচজন পুরুষের মধ্যে একজন কমপক্ষে ৬ মাস ধরে পুরুষের প্রতি যৌন আকর্ষণ অনুভব করেছেন।

  • আরেক গবেষণায় দেখা যায়, ৮.২% “সোজা” (বিষমকামী) পরিচয়ধারী পুরুষ উভকামী পর্ন দেখেন, বা গ্রুপ সেক্স-এ অংশ নেন।

  • এমনকি বিবাহিত জীবনের মধ্যেও বহু মানুষ গোপনে উভকামী সম্পর্ক রাখেন।

এর মানে হলো, উভকামিতা একটি স্বাভাবিক, ব্যাপক এবং বহুমাত্রিক যৌন আচরণ, যা বাস্তবে প্রচুর মানুষ অনুশীলন করলেও সমাজে প্রকাশ করতে ভয় পান।

সমাজে উভকামিতার স্বীকৃতির বাধা:

  • ধর্ম: অনেক ধর্ম সমকামিতাকে ‘পাপ’ বা ‘অসুস্থতা’ হিসেবে বিবেচনা করে।

  • আইন: বাংলাদেশে এখনো দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা সমকামী যৌন আচরণকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে।

  • সমাজ: যেকোনো ভিন্ন যৌন পরিচয়ের প্রতি সামাজিক বিদ্বেষ, কটাক্ষ এবং বর্জনের প্রবণতা।

  • মৃত্যুভয় ও আত্মপরিচয় হারানোর আশঙ্কা

এই সব বাধা মানুষকে নিজের যৌন পরিচয় লুকিয়ে রাখতে বাধ্য করে—যা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিপজ্জনক।

উভকামিতা কোনো ‘পর্যায়’ নয়, এটা একটি স্থায়ী যৌন পরিচয়। সমাজ যতদিন না এটা বুঝবে এবং স্বীকৃতি দেবে, ততদিন হাজার হাজার মানুষ নিজেদের অদৃশ্য রেখে বিষণ্নতা, অপরাধবোধ আর আত্মবিদ্বেষে ভুগবে।

আমরা যদি সত্যিকারের মানবিক সমাজ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে সব ধরনের যৌন বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করতে হবে, সম্মান করতে হবে। মানুষ কাকে ভালোবাসবে, সেটা তার নিজস্ব অধিকার—আর সেই অধিকারকে রক্ষা করাটাই সভ্যতার প্রকৃত মানদণ্ড।