কিছুদিন আগেই ব্রাত্য রাইসুর লিখেছিলেন – “আমি সবসময় অল্পবয়সী মেয়েদের (১৮-২১) সঙ্গেই পুংসকতা করতে চাই। আমি কি খারাপ?”-
আর এটি পাবলিশ হওয়ার পরই তিনি পড়লেন বিপাক্যা। সবাই থাকে ঠেসে ধরে বলতে লাগলো যে এসব কথা কি কেউ প্রকাশ্যে বলে নাকি? কেউ কেউ আবার জিজ্ঞেস করলেন, এসকল বিষয়ে নারীদের কি মত?
এ বিষয়ে আমার অন্তত চিন্তা স্পষ্ট। একজন পুরুষ যদি এভাবে ভাবতে পারে, এবং তা প্রকাশ্যে বলতেও পারে, তবে একজন নারী বললে ক্ষতি কি? বরং এতে একজন নারীও পুরুষদের মনের গতিবিধি বুঝতে পারবেন। শুধু তাই না, সময় থাকতে নিজের জীবনটা নিজের মত করে গুছিয়ে নিতেও পারবেন। নারীদের বয়স তো আর চিরজীবন কুরিতে আটকে থাকবে না, তাই না?
নারীদের জীবন এই সমাজই দুর্বিষহ করে তুলেছে। জন্মের পর থেকেই একটি নারীর শুরু হয় পুরুষকে সন্তুষ্ট করার পালা। আর এই সন্তুষ্টিরই আরেক নাম হলো ভালোবাসা! নারীদের সমাজ শেখায় যে তারা নিজেদের কথা ভাবতে পারবে না। ধর্ম, সমাজ, পরিবারও নারীকে অবিরত শেখায়, এই করো, সেই করো, স্বামী চাইলেই লুটিয়ে পড়ো, শ্বশুরবাড়ির সেবা করো, শাশুড়ির পা টেপো, শ্বশুরকে অজুর পানি দাও, কম খাও, কম ঘুমাও, সন্তান পালন করো…এটাই নারীর ধর্ম-কর্ম, এতেই নারীর মুক্তি– নিজের পয়ঃনিস্কাশনেরও সময় পাওয়া ভার। তবে এইগুলো করেই যে নারীদের ক্ষান্ত দেওয়া হয় তা কিন্তু না। নারীরা শিকার হয় অত্যাচারের, তবুও সে প্রেম বিলিয়ে যায়, যৌনতায় নিজেকে লুটিয়ে দেয়, শুধু উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ পাওয়ার লক্ষ্যে!
ওদিকে নারী যতো বেশি ত্যাগ করে, ততই কঠিন হতে থাকে তার জীবন। সে বোঝে না এতো করেও কেন মন পাওয়া যায় না মিনসের, গলদ কোথায়? তখন নিজেকে তার ব্যর্থ মনে হয়। ততদিনে, সময় অনেক পেরিয়ে যায়, আপনা প্রাণ বাঁচা ছাড়া তার আর করার তেমন কিছু থাকে না। কেননা সে জানে না এতো ভালোবেসেও কখন, কীভাবে ভুলপথে চালিত হয়েছে সে। জন্ম থেকে দিনের পর দিন ব্রেন ওয়াশ করে সমাজ তাকে ভুলপথে চালিত করেছে। তখন এই মাশুলও দিতে হয় নারীকেই। কেননা সমাজ তাকে শেখায়নি নারীর ভালোবাসায় পুরুষের কদর থাকে না, বরং নারীর কদর থাকে পুরুষকে অবজ্ঞা করা বা নির্লিপ্ততার মাঝে।
সেদিন জোর গলায় দেশবাসীকে হ্যাপি যখন রুবেলকে ভালোবাসার কথা বলেছিলেন, রুবেল তখন হে হে করে হেসেছে। বিয়ে করতে চাইলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছে। অতঃপর চরিত্রহীনের খেতাব নিয়ে হা-হুতাশ করতে হয়েছে হ্যাপিকে। কারণ একটিই, সে রুবেলকে ভালোবেসেছিল, বিয়ে করতে চেয়েছিল যেন আজীবন থাকতে পারে একসাথে।
শুধু রুবেল নয়, অনেক পুরুষই এমন করে, বিশেষ করে নারী নিজে গিয়ে আগ বাড়িয়ে ভালোবাসলে, ভালোবাসার কথা বললে, এবং বিয়ে করতে চাইলে এমন করেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য দেখায় তারা। চরিত্রহীনতার খেতাবও ধরিয়ে দেয় হাতে। ওদিকে তারাই হয়তো আবার আরেকটি নারীর পেছনে ছোটে, ভালোবাসে, বশ্যতা স্বীকার করে নেয়। কেন এমন হয়?
সেক্স তো দু’জনেই করেছে, পুরুষ যদি ভুলে যেতে পারে সবই, নারী কেন ভুলতে চায় না সহসা, বরং আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় আজীবন- রহস্য কী?
তাহলে মানুষের ভালোবাসা বা না বাসার সকল রহস্য কী জিনে এবং প্রকৃতিতে টিকে থাকতে? অথবা হরমোনাল? নাকি শুধু সন্তান উৎপাদন ঘটাতে?
জন্মগতভাবেই মানুষ ভালোবাসার বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়, তবে পুরুষের তুলনায় নারীর ভালোবাসার ক্ষমতা থাকে ডাবল। শরীরে ডোপামিন রাশের কারণে একজন নারী যখন সত্যিই ভালোবাসে তখন তার দিনরাত এক হয়ে যায়, খাওয়া কাজ-কর্মে মন বসে না, প্রতিটি ক্ষণ সে শুধু ঐ মানুষটিকে নিয়েই চিন্তা করতে থাকে, আর যত ভাবে ততই ভালোলাগায় বিভোর হয় সে। ফলে ডোপামিনের সক্রিয়তা আরও বাড়ে…ভালোবাসা সৌরভ ছড়ায় চারিদিকে। তার বিবেক, বুদ্ধি, আক্কেল সব লোপ পায়, কেননা সতর্ককারী বা জাজমেন্টাল নিউরন সেট, এমিগডুলা সাময়িকভাবে নিস্ক্রিয় থাকে তখন। ফলে সে তার বিপদ বা ক্ষতির কথা বিবেচনায় আনতে পারে না। ঠিক যেমনটি ঘটে নেশার ঘোরে। আর একজন নারীর যখন তার ভালোবাসার মানুষটির সাথে যৌন মিলন ঘটে, তখন অক্সিটসিনের নিঃসরণ বেড়ে যায় ৫১%। এটা ট্রাস্ট এবং বন্ডিং হরমোন– মা-সন্তানের মাঝের যে বন্ধন সেটি।
একজন নারীর শরীরে অক্সিটসিন দ্বিগুণ হয় শিশু জন্মদানের সময়, তাকে ব্রেস্ট ফিডিং করার সময়, চুম্বনে, আই কন্টাক্ট হলে যেনো হাজার কষ্ট সত্ত্বেও কোনো মা তার শিশুকে ফেলে দিতে না পারে। একজন নারীর ভালোবাসার মানুষের সাথে মিলন ঘটলে বা অর্গাজমেও অক্সিটসিনের আধিক্য কাজ করে, যেটা বন্ডিং তৈরি করে সম্পর্কটিকে স্হায়ী করতে প্রভাবিত করে। এই ডোপামিন রাশ এবং অক্সিটসিনের আধিক্যের কারণে নারী তার প্রেমিক বা বর পুরুষকে জান, সোনা, ময়না, টিয়া, তুমিই আমার জীবন, এভাবেই থেকো পাশে আজীবন, তোমার কাছে লজ্জার কী আছে, তুমি খেলেই আমার খাওয়া হয়ে যাবে…. বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলে। মনেও গেঁথে নেয় সেই সুখস্মৃতি। ভাবে, একবার সেক্স যখন হয়েছে, আপন যখন হয়েছি, আর ছাড়াছাড়ি নেই এ জীবনে। ইহকাল, পরকাল, সবকালে সে আমার, আমি তার– একসাথে। এমন কী আগামী সাত জনমও ঐ একই চূলায় হাঁড়ি বসাবার পাঁয়তারা করে সে।
ওদিকে স্বামীর সেবা, এর সেবা, ওর সেবা, এই ত্যাগ, সেই ত্যাগ দেখে পুরুষের মন যায় ঘুরে। কেননা পুরুষের জন্যে এ যেনো অনেকটা গেইম না খেলেই গেইম জেতার খেতাব পেয়ে যাওয়া। একটু আধটু আনন্দ হলেও তার আর আনন্দ অনুভূত হয় না। বরং উক্ত নারী এবং তার ভালোবাসাকে সস্তা দরের মনে হয়। হিসেব কষে, কেন একে জড়ালাম?
মন ঘুরে যেতে চায় একশ আশি ডিগ্রী–পুরো উল্টা পথে।
নরনারীর জীবন কেন এমন হয়?
সবই সৃষ্টির রহস্য। জিন ওয়ান টু ওয়ান সম্পর্কের বিপক্ষে। প্রকৃতিতে পুরুষ জাতির সন্তান জন্মদান নারীর উপর নির্ভরশীল বিধায় তাদের বৈশিষ্ট্যে থাকে টিকে থাকার তীব্র আকাঙ্ক্ষা–নানাভাবে পৃথিবীর একাধিক স্ত্রী লিঙ্গকে গর্ভবতী করে চারিদিকে রকমারি বৈশিষ্ট্যের সন্তান ছড়িয়ে দেয়া, যেন হাজার বছর পরও টিকে থাকে তার বংশধর। তাই একটি বাঁধনে আটকে পড়ে থাকার চেয়ে নতুন নতুন সম্পর্কে জড়ালে তাদের শরীরে ডোপামিনের রাশ ঘটে বেশি– আনন্দ বেশি হয়, ঘোরও লাগে বেশি, আবার নেশাও বেশি ধরে। ফলে তৎক্ষণাৎ সে মিলিত হতে চায়, আর তালে থাকে কখন এবং কেমন করে সম্ভব?
পুরুষের ক্ষেত্রে নারী/ নতুন নারীর সান্নিধ্যে ডোপামিন রাশ ভালোলাগার অনুভূতি, উত্তেজনা, আনন্দ ইত্যাদির অনুভূতি ছড়ালেও বন্ডিং এবং ট্রাস্টের অনুভূতি সরবরাহ করে না। নারীর ক্ষেত্রে বন্ডিংয়ের এই অনুভূতি ঘটায় অক্সিটসিন– যেটার নিঃসরণ বৃদ্ধি পায় সেক্স হলে। পুরুষের ক্ষেত্রে সেক্স হতেই অক্সিটসিনের হ্রাস ঘটে, কেননা টেসটসটোরনের আধিক্য অক্সিটসিনের নিঃসরণকে ব্লক করে দেয়, বা হ্রাস ঘটায়। ফলে দেখা যায় রাতে সেক্স করেও সকালে পুরুষজন আর উক্ত নারীকে মনে রাখে না, কেয়ারও করে না। কেননা সেক্স হলেও কোন বন্ডিং তৈরি হয়নি তখনও।
পুরুষের বন্ডিং তৈরি হয় কোনো নারীকে দেখে উত্তেজিত হওয়া এবং উত্তেজিত অবস্হায় কিছু বা দীর্ঘসময় ঝুলে থাকার মাধ্যমে এবং মাঝে মাঝে এই পরিস্হিতির পুনরাবৃত্তি ঘটায়। এই সময়টিতে তাদের শরীরে ডোপামিনের পাশাপাশি ভেসোপ্রেসিনের আধিক্য বাড়ে। ভেসোপ্রেসিন অক্সিটসিনের মতই বন্ডিং তৈরির কাজ করে। তবে রিসেপটর ছাড়া এটা বন্ডিং অনুভূতিতে আসে না, বা কার্যকর থাকে না। এর জন্যে দরকার হয় সময় যেন তার বডি বুঝতে পারে অমুক নারীকে আমি ভালোবাসি, তাকে আমার জীবনে বড় দরকার। এই প্রতীক্ষা করা ছাড়া বা চড়কির মতো কোনো নারীর পেছনে না ঘুরে কোনো পুরুষ যদি সেক্স পেয়ে যায়, তাহলে সে শুধু সেক্সটুকু করেই এক ডুব দিয়ে নিজেকে পরিস্কার করে ফেলে– ভুলে যায় সবকিছু।
একজন পুরুষের ভালোবাসা তার লাভ ইউ, ফুল দেয়া-নেয়া, বা ময়নাপাখি, তোতাপাখী, টিয়াপাখীর মাঝে কার্যকর নয়। বরং প্রতিশ্রুতি দেয়া এবং তা রক্ষা করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় একজন নারীর প্রতি পুরুষের ভালবাসার বন্ডিংয়ের অনুভূতি। যাকে বলা যায় পিওর লাভ। একজন নারীকে ঠিক এতোটা সময় অপেক্ষা করতে হয়, দূরে থাকতে হয়, ভালোবাসার পুরুষটিকে অবহেলা দেখাতে হয়, অথবা মনোযোগ সরিয়ে রাখতে হয় অন্য কিছুতে, যেন পুরুষের ভালোবাসার বন্ডিংটি তৈরি হয় এবং টিকে থাকে– অনেকটা নাটাইয়ে সুতা বেঁধে ঘুড়ি উড়ানো, টানো আর সময়মতো একটুখানি ছাড়ো। বেশি ছাড়লেই…. এভাবেই আজীবনের খেলা। আর তাল রাখতে না পারলে ঘুড্ডি ভোম।
বোনের কাছে গল্প শুনেছিলাম, তার এক বান্ধবীর বোন তার বোনদের হেসে হেসে বলতো, তোরা চিন্তা করিস না, রাতে তোর দূলাভাই যখন ঘুমাতে আসবে তখন সবকিছু চেয়ে নেবো–সে তখন আর না করবে না। অর্থাৎ কাছে টানতে গেলেই এটা দাও, ওটা দাও বায়না। তথা সঙ্গম হলেও এতে নারীর মনের বন্ধনে ঢিল থাকবে, তবে পুরুষটি ভালোবাসবে। জটিল অংক।
ফলে মেয়েদের তেমন কিছুই করার নেই, ‘চাচা আপনা প্রাণ বাঁচা ছাড়া’ পদ্ধতি অনুসরণ করা ছাড়া– যেহেতু ভালোবাসাতেও ব্যর্থতা, আবার না বাসাতেও। অন্য কথায়, ভালোবাসার সাথে সন্ধিস্হাপন–হয়তো প্রকৃতিই এমন।
পৃথিবীতে আট মিলিয়ন প্রজাতির মধ্যে মাত্র ১২টি প্রজাতি একই নারীর সাথে আজীবন সম্পর্ক রাখতে পছন্দ করে। এদের কিছু সংখ্যক ম্যামাল এবং অধিকাংশই পাখি। তাদেরকেও পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে সেখানেও চিটিং বিদ্যমান।
এভাবেই নারীরা বোকার স্বর্গে বসবাস করে পুরুষদের তুষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যায় সারাজীবন। তবে কি এটি ভালোবাসা? নাকি শুধুই লোকদেখানো?