২০১৬ সালে ঢাকার কলাবাগানে জুলহাজ মান্নান ও মাহবুব রাব্বী তনয়, দুই সমকামী অধিকার কর্মীকে নৃশংসভাবে খুনের পর বাংলাদেশের সমকামী সম্প্রদায় গোপনীয়তায় চলে যায়। এই ‘অদৃশ্য সংখ্যালঘু‘র অধিকার রক্ষার দাবি দমন পায়। ২০২১ সালের ৩১ আগস্টে এই হত্যাকাণ্ডের বিচারে ছয়জনের ফাঁসির রায় হলেও, সেটি দেশের পরিস্থিতি পাল্টাতে পারেনি।
২০১৬ সালের ঢাকার কলাবাগানে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ জুলহাজ এবং তনয় হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বাংলাদেশে সমকামীদের মধ্যে নিরাপত্তার অভাব বিরাজ করে। এর ফলে, তাদের মানবাধিকারের দাবি বিস্মৃত প্রায় হয়ে পড়েছে। যদিও ২০১৬ সালের হত্যাকাণ্ডের জন্য ২০২১ সালে ছয়জনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে, এর প্রভাব দেশের সমকামী সম্প্রদায়ের পরিস্থিতিতে তেমন একটা পরিবর্তন এনে দেয়নি। একজন অজ্ঞাতনামা সমকামী অধিকার কর্মীর মতে, নিরাপত্তার অভাবে এই সম্প্রদায়ের অনেকেই আত্মগোপনে বাধ্য হচ্ছেন।
বাংলাদেশে নিজের যৌন পরিচয় প্রকাশ করা অনেকের কাছে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়। মাঝে মাঝে তাদের সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, মনে করা হয় যেন সমকামিতা একটি মানসিক রোগ। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলেন এটি কোনো রোগ নয়, এটা একটি প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক বিষয়, তবুও বাংলাদেশে অনেক সমকামীকে নানান রকম সামাজিক নিগ্রহ সহ্য করতে হয়। ঘরে আটকে রাখা, মারধর, সম্পত্তি হতে বঞ্চিত করা প্রভৃতি ঘটনা প্রায়শই ঘটে। যদি কেউ তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুকে তার যৌন পরিচয় সম্পর্কে জানায়, তা দ্রুত সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়ে এবং তার পর থেকে সামাজিক নিগ্রহের শুরু হয়। এই সমাজে ‘হোমোফোবিয়া‘ এতটাই প্রবল যে, পরিচয় প্রকাশ পেলে অনেকেই সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এমনকি চাকরি হারানোর ঘটনাও ঘটে থাকে।
২০১৭ সালে ঢাকার কেরানীগঞ্জ এলাকা থেকে সমকামী হওয়ার সন্দেহে ২৭ জন পুরুষকে র্যাব গ্রেপ্তার করেছিল। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের কারণে ফেসবুক সহ অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়াতেও স্বাধীনভাবে এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা সম্ভব হয় না। এমন কিছু প্রাইভেট গ্রুপ রয়েছে যেখানে সমকামীরা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করে থাকেন, কিন্তু এসব গ্রুপের কার্যক্রম বেশিরভাগই ডেটিং পার্টনার খোঁজা নিয়ে সীমাবদ্ধ। অ্যাক্টিভিজম বা বৈরী পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো মানসিক এবং সামাজিক সহায়তা এই গ্রুপগুলো থেকে তেমন একটা পাওয়া যায় না।
বিশ্বের অনেক দেশ যখন সমকামিতাকে বৈধতা প্রদান করছে, তখন বাংলাদেশে এর স্বীকৃতির কোন সম্ভাবনা নেই নিকট ভবিষ্যতে। যেসব ব্যক্তিরা সামর্থ্যবান এবং যোগ্য, তারা দেশ ছেড়ে প্রথম সুযোগেই প্রস্থান করেন। অন্যান্যরা, যারা দেশ ছেড়ে যেতে পারেন না, তাদেরকে তাদের পরিচয় লুকিয়ে ভয়ের সঙ্গে জীবন কাটাতে হয়। সমকামী অধিকার অ্যাক্টিভিজম এখন মাইক্রো লেভেলে নেমে এসেছে, হাতে গোনা কিছু ছোট ছোট গ্রুপ বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করছে। নিরাপত্তার স্বার্থে তারা বৃহত্তর রাজনৈতিক দৃশ্যপটে প্রবেশের কোনো আগ্রহ প্রকাশ করছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে, কেবল কয়েকজনকে এম্পাওয়ার করা সম্ভব হচ্ছে।
মিডিয়ায় প্রকাশিত আত্মহত্যার সংবাদগুলো প্রায়ই বিস্তারিত কারণ ছাড়াই প্রকাশ পায়, এবং অনেক সময় সত্যিকার প্রেক্ষাপট ধামাচাপা পড়ে যায়। গে এবং লেসবিয়ান কমিউনিটির মধ্যেও বাই-সেক্সুয়াল বা উভকামী ব্যক্তিদের নিয়ে নানান ভীতি ও অনিশ্চয়তা বিরাজ করে। এর উপর দেশের গোঁড়া ধর্মীয় আবহ ও ধর্মান্ধতা সমকামীদের জন্য পরিস্থিতিকে আরও কঠিন করে তোলে। এই অবস্থায়, সমকামী ব্যক্তিদের জন্য স্বীকৃতি এবং সামাজিক মান্যতা পাওয়া বিশেষত চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠে। এর ফলে কমিউনিটির অনেকেই মানসিক চাপ এবং বিচ্ছিন্নতাবোধে ভুগে থাকেন।