
ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি—যার সীমা, পরিধি বা গন্তব্য বাধ্যতামূলকভাবে পুরুষ ও নারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। প্রেম মানেই দুটি হৃদয়ের মিলন, তা যে রূপেই হোক না কেন। কিন্তু বাংলাদেশে আজও এমন অনেক মানুষ রয়েছেন—যাঁদের ভালোবাসা ফৌজদারি অপরাধে পরিণত হয়েছে। কারণ তাঁরা সমলিঙ্গের মানুষকে ভালোবাসেন।
এদেশে এখনো দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বলবৎ রয়েছে, যা “প্রকৃতিবিরুদ্ধ যৌনাচার” নামে যেকোনো সমকামী সম্পর্ককে অপরাধ হিসেবে দেখায়। এই ঔপনিবেশিক আইন শুধু পুরনো নয়, বরং মানবাধিকারের পরিপন্থীও বটে।
সমকামিতা: একটি প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য
সমকামিতা কোনো অস্বাভাবিকতা নয়। এটা বিজ্ঞানে স্বীকৃত একটি যৌন বৈচিত্র্য। পৃথিবীর প্রায় ১,৫০০ প্রজাতির প্রাণীর মধ্যে সমকাম আচরণ দেখা গেছে—যার মধ্যে মানুষ অন্যতম। অর্থাৎ এটা প্রকৃতির অংশ, বিকৃতি নয়।
শিশুরা যখন জন্মায়, তখন তাদের মধ্যে কোনো ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক ধারণা থাকে না। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার, সমাজ ও ধর্ম তাদের বিশ্বাস গড়ে দেয়। কিন্তু কেউ যদি নিজের যৌন পরিচয়ে অন্যরকম হয়ে ওঠে, সেটা কি তার দোষ? না, এটা তার বেঁচে থাকার এক স্বাভাবিক উপায়।
বাংলাদেশে সমকামীদের বাস্তবতা
বাংলাদেশে সমকামীদের জীবন দুর্বিষহ। কেবল সামাজিক বিদ্বেষ নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায়েও তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য চলমান। পুলিশি হয়রানি, গোপনে গ্রেফতার, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য, পরিবারের দ্বারা নির্যাতন, এমনকি খুন পর্যন্ত—সবই বাস্তবতা। অনেকে জীবনের নিরাপত্তাহীনতায় দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
অনলাইন প্ল্যাটফর্ম বা গোপন কমিউনিটি যেন একমাত্র আশ্রয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এই আশ্রয়ও নিরাপদ নয়। উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর হুমকি, অনলাইন নজরদারি এবং রাষ্ট্রীয় স্তরে নজরদারি—সব কিছুই সমানতালে বেড়েছে।
রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব
বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সংবিধান অনুযায়ী, প্রতিটি নাগরিকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ, পছন্দ ও জীবনযাপন করার অধিকার থাকা উচিত। অথচ, সমকামীদের এই ন্যায্য অধিকার সংবিধান স্বীকৃতি দিলেও, বাস্তবে আইনি ও সামাজিক কাঠামোতে তা ধ্বংস হয়ে যায়।
জাতিসংঘের বিভিন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশ LGBTQ+ অধিকার নিয়ে প্রশ্ন উঠলে, আমাদের প্রতিনিধি দল সব সময় বলে—“এটা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে।” কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতি কি মানুষের অধিকারের চেয়ে বড়?
ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টিপাত
ভারত, নেপাল, তাইওয়ানসহ এশিয়ার অনেক দেশ ইতোমধ্যেই ৩৭৭ ধারা বাতিল করেছে বা সমকামীদের অধিকার স্বীকার করেছে। বাংলাদেশ কেন এই পরিবর্তনের পথে হাঁটতে পারবে না?
সমকামীদের অধিকার মানে সমাজের ভাঙন নয়, বরং তার সংহতি। বৈচিত্র্যকে সম্মান করা মানে মানবিক সমাজের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
আমাদের করণীয় কী?
-
দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা বাতিল করতে হবে।
-
বৈষম্য বিরোধী আইন প্রণয়ন করতে হবে।
-
শিক্ষা কারিকুলামে যৌন ও লিঙ্গ পরিচয় বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
-
গণমাধ্যমে সমকামিতা নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা বন্ধ করতে হবে।
-
ধর্ম নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে হবে।
শেষ কথা
ভালোবাসা কোনো অপরাধ হতে পারে না। একে অপরকে সম্মান, ভালোবাসা ও মর্যাদা দেওয়ার অধিকার প্রত্যেকের রয়েছে। সমকামীদের অধিকার মানে কেবল একটি গোষ্ঠীর স্বীকৃতি নয়, এটি মানবতা ও ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা।
বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হলে, সমকামিতাকে অপরাধ নয়, অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতেই হবে।