মানুষের প্রকৃতি জটিল এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। আমরা প্রত্যেকেই আলাদা—চেহারা, ভাষা, স্বভাব, পছন্দ-অপছন্দ, এবং হ্যাঁ—যৌন অভিমুখতাও। সমকামী, উভকামী বা বিষমকামী—এই বৈচিত্র্য শুধু সমাজে নয়, আমাদের জিন, হরমোন এবং মস্তিষ্কের গঠনেও দৃশ্যমান। অথচ আজও, বহু মানুষ সমকামীদের ‘অসুস্থ’ বলে আখ্যা দেয়। বাস্তবে, এই দৃষ্টিভঙ্গিটাই নিজে এক ধরণের অসুস্থতা—অজ্ঞতা, অমানবিকতা এবং ঘৃণার এক ধ্বংসাত্মক রূপ।

আজকের বিশ্বে বিজ্ঞান বহু বিষয়েই আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। যৌন অভিমুখতার বিষয়টিও এর ব্যতিক্রম নয়। আধুনিক গবেষণা বলছে—একজন মানুষের যৌনতা তার জৈবিক গঠন, হরমোনের ভারসাম্য ও গর্ভাবস্থার সময়কার পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা X ক্রোমোজোমের Xq28 অংশকে সমকামীদের জৈবিক বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে যুক্ত বলে শনাক্ত করেছেন। আবার মস্তিষ্কের একটি অংশ—হাইপোথ্যালামাস—এর INAH3 নিউক্লিয়াস সমকামী পুরুষদের ক্ষেত্রে বিষমকামী নারীদের মতো গঠিত থাকে।

এমনকি ‘কর্পাস কলোসাম’ এবং ‘অ্যান্টেরিয়র কমিসারস’, দুটি অংশ যারা ভাষাগত দক্ষতার জন্য দায়ী, সেগুলোর আকারও সমকামী পুরুষদের ক্ষেত্রে নারীদের মতো বৃহৎ হয়।

সমকামী হওয়া কারও ইচ্ছাধীন বিষয় নয়। একে “বিকল্প” বলে দেখানো যেমন ভুল, তেমনি একে “অসুখ” বলাও এক ধরনের সামাজিক বিভ্রান্তি। গবেষণায় দেখা গেছে—যমজ ভাইবোনদের মধ্যে একজন যদি সমকামী হয়, তাহলে অপরজনের সমকামী হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। এর অর্থ, যৌন অভিমুখতা জন্মসূত্রে নির্ধারিত।

তবে এসব বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ছাড়াও একটা সাধারণ সত্য আমরা উপেক্ষা করতে পারি না—যে কেউ নিজেকে যেমন অনুভব করে, সেটাই তার সত্যিকারের পরিচয়। এই পরিচয়কে অস্বীকার করা মানে একজন মানুষকে অস্বীকার করা।

ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় সমকামিতাকে ‘পাপ’ বা ‘অসুস্থতা’ হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো—একজন মানুষ যদি কাউকে ভালোবাসে, তাতে পাপ কোথায়? যেখানে ধর্ম ভালোবাসা, সহানুভূতি ও সহিষ্ণুতার শিক্ষা দেয়, সেখানে ঘৃণা, বিদ্বেষ আর বর্জনের এই সংস্কৃতি কেমন করে ধর্মীয় বলে স্বীকৃতি পায়?

যদি কোনো ধর্ম মানুষকে তার পরিচয় ও ভালোবাসার জন্য ঘৃণা করতে শেখায়, তাহলে সেই ধর্মকে প্রশ্ন করা জরুরি।

সমাধান কী?

  • সচেতনতা বৃদ্ধি: স্কুল, কলেজ, সামাজিক মিডিয়া, ও গণমাধ্যমে যৌন অভিমুখতা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা হওয়া জরুরি।

  • আইনি স্বীকৃতি: সমকামীদের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য ৩৭৭ ধারা বাতিল করতে হবে, এবং বৈষম্যবিরোধী আইনে যৌন অভিমুখতা যুক্ত করতে হবে।

  • মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি: প্রতিটি মানুষ তার পরিচয়, প্রেম ও জীবন নিয়ে গর্ব করতে পারে—এমন সমাজ গড়ে তুলতে হবে।

 

 

সমকামীদের ‘অসুস্থ’ বলা মানে একজন স্বাভাবিক মানুষকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। এই দৃষ্টিভঙ্গি শুধুই অমানবিক নয়, বরং অজ্ঞতা ও ঘৃণার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। এখনই সময়, আমরা এই মিথ ও ভুল ব্যাখ্যাগুলো ভাঙব, এবং সবাইকে একজন মানুষ হিসেবে মেনে নেব—যার ভালোবাসার অধিকার, মর্যাদা, এবং জীবনের স্বাধীনতা আছে।

সমকামিতা কোনো অসুখ নয়। বরং যিনি তা ঘৃণা করেন, তার মানবিক বোধটাই আজ প্রশ্নের মুখে।