
মাজে আমরা প্রায়ই তিনটি শব্দ শুনে থাকি—বিষমকামী (heterosexual), সমকামী (homosexual) এবং উভকামী (bisexual)। তবে এই শব্দগুলোর প্রকৃত অর্থ ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নিয়ে আমাদের অনেকের ধারণা অস্পষ্ট। যৌনতা, লিঙ্গ পরিচয়, এবং মানসিক আকর্ষণের মধ্যে পার্থক্য বুঝতে গেলে আগে আমাদের কিছু মৌলিক বিষয়ের সঙ্গে পরিচিত হওয়া জরুরি।
লিঙ্গ ও যৌনতার চারটি স্তর: ‘A Guide to Gender’ থেকে
স্যাম কিলারম্যান তাঁর বই A Guide to Gender-এ এই চারটি স্তরের কথা উল্লেখ করেছেন যা একজন ব্যক্তির যৌন ও লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণে সহায়ক:
-
Gender Identity (লিঙ্গ পরিচয়): একজন ব্যক্তি মানসিকভাবে নিজেকে কোন লিঙ্গ হিসেবে চিন্তা করেন—পুরুষ, নারী, উভয়ই অথবা কোনোটি না।
-
Gender Expression (লিঙ্গ প্রকাশভঙ্গি): একজন কীভাবে নিজের পোশাক, আচরণ, সাজসজ্জা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাজের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেন।
-
Biological Sex (জৈবিক লিঙ্গ): একজনের শরীরী কাঠামো—যার ভিত্তি হলো ক্রোমোজোম, হরমোন, যৌনাঙ্গ ইত্যাদি।
-
Sexual Orientation (যৌন অভিযোজন): একজন ব্যক্তি কার প্রতি মানসিক ও যৌন আকর্ষণ অনুভব করেন।
এই চারটি দিক বাইনারি নয়—অর্থাৎ, শুধু নারী/পুরুষ বা সোজা/বাঁকা নয়। এগুলো একেকটি স্পেকট্রাম বা ধূসর অঞ্চলে বিস্তৃত।
ইন্টারসেক্স: জৈবিক লিঙ্গের বহুরূপতা
জন্মের সময় আমরা সাধারণত কাউকে নারী বা পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত করি। কিন্তু অনেক মানুষ জন্মান এমন এক শারীরিক কাঠামো নিয়ে, যেখানে পুরুষ ও নারীর উভয় বৈশিষ্ট্য থাকে—তাদের বলা হয় ইন্টারসেক্স। তাদের লিঙ্গ পরিচয় নির্ধারণ অনেক সময় সামাজিক বা চিকিৎসাগত সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে, কিন্তু মানসিকভাবে তারা কাকে অনুভব করেন, সেটাই আসল পরিচয়।
Sexual Orientation: আকর্ষণের স্বাভাবিকতা
সমাজে অধিকাংশ মানুষ বিষমকামী—বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট। কেউ সমকামী, অর্থাৎ একই লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হন। আবার অনেকে উভয় লিঙ্গের প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করেন—তাদের বলা হয় উভকামী (bisexual)।
এছাড়াও কিছু মানুষ যৌনতায় আকর্ষণ অনুভব করেন না—তাদের বলা হয় asexual।
এদের কেউ কেউ নিজেদের যৌন অভিযোজন ছোটবেলায় বুঝে ফেলেন, কিন্তু সমাজের চাপে তা গোপন (closeted) রাখেন। আবার কেউ কেউ বয়স ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিবর্তনশীল (fluid) অনুভব করেন।
ড. লিসা ডায়মন্ড-এর গবেষণায় দেখা গেছে, অনেক নারী বছরের পর বছর বিষমকামী সম্পর্কে থেকে পরে সমকামী সম্পর্কে আকৃষ্ট হয়েছেন। এটাই প্রমাণ করে—যৌন অভিযোজন কোনো নির্দিষ্ট বাক্সে আটকে রাখা যায় না।
উভকামীতা এবং সমাজের অস্বীকৃতি
দুঃখজনকভাবে, উভকামীদের প্রায়ই সমাজ অস্বীকার করে বা অবিশ্বাস করে। অনেকেই মনে করেন, “এরা শুধু কনফিউজড”। এই ধরণের মানসিকতা বাইফোবিয়া সৃষ্টি করে—যা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
উভকামী ব্যক্তি সমাজে যেমন লুকিয়ে থাকতে বাধ্য হন, তেমনি অনেক সময় এলজিবিটি সম্প্রদায়ের মধ্যেও অবিশ্বাসের শিকার হন।
শেষ কথা: বৈজ্ঞানিক সত্য এবং মানবিক স্বীকৃতি
যৌন অভিযোজন মানুষের একটি স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এটা জন্মগত, জৈবিক এবং মানসিকভাবে প্রভাবিত। কেউ কাকে ভালোবাসবে বা কার প্রতি আকৃষ্ট হবে—এটা একটি ব্যক্তিগত, স্বাভাবিক, এবং সম্মানের যোগ্য পরিচয়।
সঠিক শিক্ষা, সচেতনতা এবং মানবিকতা দিয়েই গড়ে উঠতে পারে এমন একটি সমাজ, যেখানে কেউ তার পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হবে না।
ধর্ম, সমাজ কিংবা সংস্কৃতি—কোনোটাই মানুষের প্রকৃতি অস্বীকার করতে পারে না। বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দিন, মানুষকে মানুষ হিসেবে মেনে নিন। সবার ভালোবাসার অধিকার এক।